লাইব্রেরি সেই কোণায়
মাহি'র ✍🏻 কলম থেকে!
আমি জানি না ভালোবাসা কি, কিন্তু আজ যখন এই কাগজে লিখতে বসেছি, মনে হচ্ছে শব্দগুলো যেন নিজেরাই গুছিয়ে নিচ্ছে। হয়তো ভালোবাসা এমনই - অনিয়মের মধ্যে এক ধরনের গোছালো আবেশ, যেমন বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় হঠাৎ পাওয়া কোনো পুরনো গানের সুর।
•|• প্রথম দেখা: লাইব্রেরির সেই কোণায় •|•
মেঘলা এক সকালে রিদয়ের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা! কলেজের লাইব্রেরির সেই কোণায়, যেখানে সকালের রোদ এসে পড়ে বইয়ের পাতায় আলোর নাচন তৈরি করে ? আমি তখন হুমায়ুন আহমেদের "নক্ষত্রের রাত" খুঁজছিলাম, হাত বুলাচ্ছিলাম পুরনো বইয়ের স্তূপে | হঠাৎ একজোড়া হাত এসে থামল সেই বইয়ের উপর। মাথা তুলতেই দেখি একঝলক হাসি | "এই বইটা আমারও প্রিয়," বলল এক অচেনা কণ্ঠ সুরে | চোখে চোখ রেখে হাসলাম • জানতাম না, সেই হাসিই আমাকে টেনে নিয়ে - যাবে এক অজানা গল্পে, যেখানে প্রতিটি পাতায় লেখা থাকবে আমাদের নাম |
সেই দিনই জানলাম তার নাম রিদয় | পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র, কিন্তু মনটা যেন কবিতায় ভরা। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আমরা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম বৃষ্টিতে। সে বলল, "বৃষ্টি আসলে আকাশের অশ্রু, যখন সে পৃথিবীকে খুব মিস করে | " আমি বললাম, "তাহলে আজ আকাশ খুব কাঁদছে। " সে হাসল, "না, আজ সে শুধু আমাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।"
•|• রিদয়ের অদ্ভুত দুনিয়া •|•
রিদয়ের কথা বলার ধরন আলাদা। সে যখন বলে, "তুমি জানো, আকাশ কেন নীল? "আমি মাথা নাড়ি। তখন সে গল্প জুড়ে দেয়-প্রকাশের বিচ্ছুরণ, আলোর রঙিন খেলা, আর আমার অজান্তেই তার দিকে তাকিয়ে থাকার বিজ্ঞান। আমি শুধু ভাবতাম, "এই লোকটা কি সব জানে?"
একদিন সে আমাকে নিয়ে গেল শহরের ওই পুরনো জাদুঘরে | টেলিস্কোপের মাধ্যমে কল্পনার জগত! দেখিয়ে বলল, "দেখো, এই সেই রাজ্যে ? যেখানে তুমি - রাণী - আর আমি রাজা"
•|• কফি, তারা আর অসমাপ্ত গল্প •|•
দিন যায়। আমরা ক্যাফেতে বসে এক কাপ কফি শেয়ার করি。 রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সে আমাকে শেখায় নক্ষত্র চেনার কৌশল | "ওই যে তিনটে তারা এক সরল ভাবে অনলাইনে আছে, ওটা ওরিয়নের বেল্ট,"বলল সে এক রাতে | আমি বললাম, "আমি তো শুধু আলোর বিন্দু দেখতে পাচ্ছি।" সে হাসল, "ঠিক যেমন আমি প্রথম দিনে শুধু একটা মেয়েকে দেখেছিলাম বই নিয়ে, কিন্তু এখন দেখি এক গল্পের নায়িকাকে।"
একদিন সে বলল, "তুমি যদি বইয়ের পাতায় লুকিয়ে থাকো, আমি তোমাকে খুঁজে বের করব।" প্রশ্ন করলাম, "কিভাবে?" সে হাসল, "তোমার গল্পের পাতায় গন্ধ থাকবে ল্যাভেন্ডারের। আর প্রতিটি অধ্যায়ে থাকবে আমার জন্য একটু জায়গা।"
•|• ঝগড়া এবং রজনীগন্ধার গন্ধ •|•
ভালোবাসা কি শুধু মিষ্টি কথা? না | একদিন তুমুল ঝগড়া হলো আমাদের। কারণ তুচ্ছ! আমি বললাম, "তুমি সময় মানো না," আর সে রেগে বলল, "তোমার অত নিয়মের জীবন আমি পারব না।" দুজনেই চুপ। মনে হলো, এই বুঝি সব শেষ।
কিন্তু সেই রাতেই কে যেন দরজায় টোকা দিল। খুলতেই দেখি রিদয় দাঁড়িয়ে, হাতে এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা | তার চোখে-মুখে অদ্ভুত এক ব্যাকুলতা | বলল, "ক্ষমা চাইতে শিখিনি কখনো, কিন্তু তোমার জন্য প্রথমবার চেষ্টা করছি।" আমি কাঁদতে কাঁদতে হাসলাম। বুঝলাম, ভালোবাসা মানে শুধু সহজ সময় নয়, ঝগড়ার পর ফিরে আসার সাহসও |
•|• চার বছর পর: এক নতুন অধ্যায় শুরু •|•
চার বছর কেটে গেল। আজ আমাদের বিয়ে | লাল শাড়ি পরেছি আমি, রিদয় পরেছে পাঞ্জাবি। বিয়ের আসরে যখন ফুলমালা বদল হচ্ছিল, সে কানে কানে বলল, "তুমি জানো, পৃথিবী কেন ঘোরে?" আমি বললাম, "না।" সে হাসল, "আমাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য।"
আর আমি? লিখে যাই আমাদের গল্প - যেখানে ভালোবাসা শুধু কবিতা নয়, রোজকার হাসি-কান্নার সমষ্টি | প্রতিটি অধ্যায়ে আছে বৃষ্টিভেজা সকাল, রাতের তারা, কফির কাপ আর অসমাপ্ত কথার মিষ্টি স্বাদ।
•|• ফ্ল্যাশব্যাক •|•
√ অধ্যায় ১: পরিচয়ের পরের দিনগুলো
পরের দিনগুলোতে আমাদের দেখা হতো ক্যাম্পাসের বিভিন্ন কোণে | রিদয় আমাকে নিয়ে যেত তার প্রিয় জায়গাগুলোতে - পুরনো সেই বইয়ের দোকান যেখানে দেয়ালে দেয়ালে স্টিকার আঁকা, নদীর ধারের সেই বেঞ্চ যেখানে বিকেলে কাকদের দল জমায়েত হয় | একদিন সে হঠাৎ বলল, "আমি তোমার জন্য একটা কবিতা লিখেছি।" বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতেই সে পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করল। তাতে লেখা ছিল:
"তুমি যদি হও বৃষ্টি,
আমি হব মেঘ,
যেখানে তুমি পড়বে,
সেখানে আমি গিয়ে জড়ো হব..."
আমি লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিলাম, কিন্তু মনে মনে ভেবেছিলাম - এই লোকটা কি আমার হৃদয়ের ভাষা জানে?
√ অধ্যায় ২: প্রথম জন্মদিন একসাথে
রিদয়ের জন্মদিনে আমি তাকে একটা টেলিস্কোপ উপহার দিয়েছিলাম | সে অবাক হয়ে বলল, "এটা তো অনেক দামি!" আমি বললাম, "তুমি আমাকে যে জিনিসটা শিখিয়েছ - তারা দেখার আনন্দ - তা তো দাম দিয়ে মাপা যায় না | " সেদিন রাতে আমরা ছাদে বসে কেক কাটলাম | সে বলল, "জন্মদিনের কেকের মোম ফুঁ দিতে গিয়ে নাকি ইচ্ছা পূরণ হয়।" আমি জিজ্ঞেস করলাম, "তোমার ইচ্ছা কি?" সে চোখ বুজে বলল, "যে ইচ্ছা বললে পূরণ হয় না।"
√ অধ্যায় ৩: দূরত্বের সময়
রিদয়ের ইন্টার্নশিপের জন্য তিন মাস অন্য শহরে যেতে হলো | এই প্রথম আমরা দূরে থাকলাম - ফোনে তার কণ্ঠ শুনে আমি কাঁদতাম | সে আমাকে প্রতিদিন ইমেলে কবিতা পাঠাত। একদিন লিখেছিল:
"দূরে থেকেও তুমি
আমার নিঃশ্বাসের সঙ্গে,
যেমন চাঁদ থাকে সমুদ্রের জোয়ারে..."
আমি উত্তর দিয়েছিলাম: "ফিরে এসো, নইলে আমি তোমার সব বই উল্টে-পাল্টে ফেলব!"
√ অধ্যায় ৪: প্রস্তাব এবং নতুন জীবন
রিদয় ফিরে এসে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলো আমাদের প্রথম দেখা লাইব্রেরিতেই | সে বইয়ের ভেতরে একটা রিং লুকিয়ে রেখেছিল। যখন আমি বই খুললাম, তখন সবাই তালি দিতে লাগল। আজ আমরা একসাথে | এখনো সে রাতে আমার জন্য তারা দেখায়, আর আমি তাকে শেখাই কিভাবে রান্নায় লবণ কম দিতে হয়।
ভালোবাসা আমাদের এই গল্প - অসম্পূর্ণ, কিন্তু সুন্দর।
[সমাপ্ত]