ফিরে দেখা সেই দিনগুলো ও শেষ পাতার চিঠি
👉🏼 ফিরে দেখা সেই দিনগুলো
বিকেল শেষে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটার মুখে যেন অন্যরকম এক আলো এসে পড়ছে? নাম তার লাবণ্য - কলেজ লাইফে সবার চোখে পড়ার মতো নয়, তবু চোখে-মুখে একটা অদ্ভুত শান্তি ছিল, যা কেউ কেউ ভালোভাবে খেয়াল করলে বুঝতে পারতো তার গভীরতা | ওর গল্পটা শুরু হয়েছিল গ্রামের ছোট একটা স্কুল থেকে...
লাবণ্য ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম ছিল। বাকি মেয়েদের মতো মেকআপ, ফ্যাশন এসবের প্রতি তার আগ্রহ নেই বললেই চলে | সে ভালোবাসতো বই পড়তে, প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে। তার সবচেয়ে পছন্দের সময় ছিল বৃষ্টির দুপুরগুলো | কাগজে-কলমে সে যেন নিজের একটা জগৎ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু সবকিছু বদলে গেল যেদিন শহর থেকে একটা ছেলে ওদের স্কুলে ট্রান্সফার হয়ে এল - নাম ছিল আরিয়ান।
আরিয়ান শহরের ছেলে হলেও, আচরণে ছিল ভীষণ সহজ-সরল | প্রথম দিনেই ক্লাসে সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিল, |• আমি আসলে চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি, তবে বন্ধুত্ব করতে ভালোবাসি •| 👉🏼 তার এমন সরল কথাগুলো যেন লাবণ্যর মনে একটা দোলা দিয়ে গেল ? প্রথম কয়েক মাস দুজনের তেমন কথা হতো না, কিন্তু ধীরে ধীরে একে অপরের সাথে কথা বলতে লাগল - সেই থেকে আস্তে আস্তে দুজনের প্রতি টান তৈরি হতে লাগল
একদিন স্কুল শেষে হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হলো। লাবণ্য ছাতা আনেনি - আরিয়ান এগিয়ে এসে নিজের ছাতার নিচে জায়গা দিল | তারা একসাথে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছিল •|• প্রথমবার এত কাছে এল তারা - সেদিনের বৃষ্টির ফোঁটার মতোই সম্পর্কটাও জমে উঠল নিঃশব্দে, নিঃশর্তে।
কলেজে উঠার পর দুজন দুই শহরে চলে গেল - কিন্তু দূরত্ব তাদের ভালোবাসা কমাতে পারেনি। প্রতিদিনের মেসেজ, ফোনে গল্প, কবিতা পাঠানো - সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক •|• লাবণ্য যেন মনে মনে প্রতিদিন গুছিয়ে নিচ্ছিল ভবিষ্যতের গল্প | কিন্তু একদিন হঠাৎ করেই সব থেমে গেল ? আরিয়ান ফোন ধরা বন্ধ করে দিল, কোন মেসেজের উত্তর দিল না।
লাবণ্য ভেঙে পড়েছিল, ভীষণভাবে - কয়েক মাস কেটে গেল এই অজানার অন্ধকারে | সে বুঝতে পারছিল না কি হয়েছে •|• ভেবেছিল, হয়তো সে আর নেই, বা হয়তো কাউকে ভালোবেসে ফেলেছে | কিন্তু হঠাৎ একদিন, সন্ধ্যাবেলায় একটা অচেনা নম্বর থেকে ফোন এলো।
ওপাশে আরিয়ানের মা - ভাঙা গলায় বললেন? •|• আরিয়ান এখন হাসপাতালে - মস্তিষ্কে টিউমার ধরা পড়েছে, অনেকদিন ধরেই ভুগছিল, কিন্তু তোমাকে কিছু জানায়নি - কারণ, সে চায়নি তুমি তার কষ্টে কষ্ট পাও •|• লাবণ্য যেন স্তব্ধ হয়ে গেল, চোখের জল ঠেকাতে পারল না।
সে সব ফেলে ছুটে গেল হাসপাতালে - বিছানায় শুয়ে থাকা আরিয়ানকে দেখে মনে হচ্ছিল - সময় যেন ছিনিয়ে নিচ্ছে তাকে প্রতিটি মুহূর্তে | লাবণ্য চুপচাপ বসে রইল পাশে • হঠাৎ আরিয়ান চোখ খুলে তাকিয়ে বলল, তুমি এসেছো? আমি জানতাম তুমি আসবে...
সে দিনগুলোর শুরু ছিল নতুন এক যাত্রার •|• চিকিৎসার খরচ, সময়, আবেগ - সব কিছুতে লাবণ্য ছিল একা, কিন্তু সে লড়াই থামায়নি | সে ঠিক করেছিল, ভালোবাসা মানেই শুধু খুশির দিন নয়, কষ্টের দিনেও পাশে থাকা।
বছরখানেক পর, অনেক লড়াইয়ের পরে, আরিয়ান সুস্থ হলো - ডাক্তার বলেছিল, •|• এটা একটা মিরাকল।” লাবণ্য তখন শুধু বলেছিল, ভালোবাসা কখনও হার মানে না •|• তারা দুজন নতুনভাবে শুরু করেছিল তাদের গল্প, আরও গভীর ভালোবাসা নিয়ে।
আজ ১০ বছর পর, লাবণ্য সেই জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, হাতে ধরা চায়ের কাপ | পাশেই খেলার ঘরে দৌড়াচ্ছে তাদের ছেলে অর্ক। পেছন থেকে আরিয়ান এসে জড়িয়ে ধরে বলল, •|• এই জীবনে তুমি না থাকলে হয়তো কিছুই থাকতো না ? লাবণ্য মুচকি হেসে বলল, আমার জীবন তো তুমিই... |
📌 | ভালোবাসা শুধু প্রাপ্তির নাম নয়, ভালোবাসা মানেই ত্যাগ, অপেক্ষা, আর একে অপরের পাশে থাকার অঙ্গীকার •|• লাবণ্য আর আরিয়ানের এই গল্পটা আমাদের শেখায় - যদি মন থেকে ভালোবাসো, তাহলে কোনো দূরত্বই তোমাদের আলাদা করতে পারে না।
সমাপ্ত
👉🏻 শেষ পাতার চিঠি
কিছু সম্পর্ক শুরু হয় না, কিন্তু শেষও হয় না •|• থেকে যায় একটা চিঠির মতো-যা পড়াও যায় না, ফেলা তো একেবারেই নয়।
প্রথম অধ্যায় | সেই প্রথম দেখা
সন্ধ্যাবেলা ছিল, স্কুল থেকে ফেরার পথ •|• আকাশে হালকা মেঘ, হাওয়ায় গন্ধ ছিল বৃষ্টির | সেদিনই প্রথম ওকে দেখি, নীল ওড়না উড়িয়ে রিকশা থেকে নামছিল। আমার চেহারাটা হয়তো সাধারণ, কিন্তু চোখে পড়ে গেল ওর চোখ দুটো-মায়া, কিন্তু খালি - যেন কিছু খুঁজছে |
আমার নাম অনিক | ক্লাস টেনে পড়ি - পড়াশোনায় খুব ভালো না, তবে স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসি • আর ও ছিল রূপা - নতুন ছাত্রী, সদ্য শহরে এসেছে গ্রামের মেঠো পথ ছেড়ে •|• জানতাম না, এই মেয়েটাই আমার জীবনের প্রতিটি পাতায় লেখা থাকবে।
দ্বিতীয় অধ্যায় | ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব
শুরুটা হয়েছিল বই ফেরত দেয়া থেকে | রূপা ভুল করে আমার বই নিয়ে চলে গিয়েছিল | আমি পরদিন স্কুলে ওকে বইটা ফিরিয়ে দিলাম।
তোমার বই |
ওহ! থ্যাঙ্ক ইউ| আমি বুঝতেই পারিনি |
সেই ছোট্ট কথার বিনিময়ে শুরু হয়েছিল এক বন্ধুত্ব। ধীরে ধীরে একসাথে টিফিন খাওয়া, একসাথে লাইব্রেরি যাওয়া, আর ছুটির পরে একটু হাঁটা-হাঁটি করা।
ওর গল্প শুনতাম-ওর গ্রামের কথা, ওর ঠাকুরমার হাতের পায়েস, আর নিঃসঙ্গ দুপুরবেলাগুলোর কথা। আমি হাসতাম, আবার ওর দুঃখের কথা শুনে চুপ হয়ে যেতাম।
তৃতীয় অধ্যায় | অজানা অনুভব
রূপা পাশে থাকলে, যেনো সময় থেমে যেত - সন্ধ্যায় ফিরতে দেরি হলে মা বকত, কিন্তু মন পড়ে থাকত স্কুলের বেঞ্চে, যেখানে ওর পাশে বসে থাকতাম।
কোনোদিন বলিনি ওকে কিছু, শুধু চাইতাম - ও যেন ভালো থাকে।
একদিন রূপা বলল,
তুই খুব ভালো বন্ধু, জানিস?
আমি হাসলাম, অথচ মনে হল কেউ যেন বুকের ভেতরটা চেপে ধরল।
ওর চোখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে ছিলাম | অনেক কিছু বলতে চেয়েও বলা হয়নি - কেন যেনো ভয় হয়েছিল, যদি হারিয়ে যায় ও |
চতুর্থ অধ্যায় | হঠাৎই বিদায়
হঠাৎ একদিন স্কুলে এল না রূপা | পরদিনও না - শুনলাম, ওর বাবা বদলি হয়েছেন •|• হুট করেই চলে গেছে পরিবারসহ অন্য জেলায়।
কোনো চিঠি না, কোনো বিদায় না - কিছুই না।
দিনগুলো চলতে লাগল, স্কুল শেষ হলো | আমি কলেজে ভর্তি হলাম, বন্ধুদের ভিড়েও একা লাগত।
রূপা থাকত না, কিন্তু ওর জন্য বুকের কোনে রাখা ভালোবাসা যেন থেকে গিয়েছিল। অপ্রকাশিত, অনুনয়হীন।
পঞ্চম অধ্যায় | পুনর্মিলন
৮ বছর পর | আমি তখন সাংবাদিক - একদিন বরিশালে গিয়েছিলাম রিপোর্টিং এর কাজে | এক অফিসে গিয়ে দেখি - একটা মেয়ের মুখ বড় চেনা লাগছে | আমার বুক ধড়ফড় শুরু করল - সেই তো! রূপা!
ওর মুখেও বিস্ময় - তুই?! অনিক?!
আমরা অনেক কথা বললাম | ও এখন চাকরি করে, বিয়ে হয়নি •|• আমিও ব্যস্ত জীবনে জড়িয়ে গেছি, কিন্তু সেদিন কফির টেবিলে যেন সময় আটকে গিয়েছিল দুজনের।
ও বলল,
👉🏼 তুই কি আজও মনে করিস আমাকে?
আমি বললাম না কিছু, শুধু একটা পুরোনো ডায়েরির পাতায় লেখা চিঠিটা বের করলাম।
“রূপা,
আমি তোকে আজও ভালোবাসি •|• বলার সাহস হয়নি কখনও | তুই চলে যাবার পরও তোকে ভুলতে পারিনি আমি ।
ও চিঠিটা নিয়ে চোখের পানি লুকিয়ে বলল -
–আমিও ভুলিনি তোকে, অনিক…
শেষ অধ্যায় | শেষ পাতার চিঠি
আমরা আজো একসাথে নেই, কিন্তু প্রতিদিন কথা হয় | ভালোবাসা হয়তো সবসময় একসাথে থাকা নয়, কখনো সেটা হয় অপেক্ষা, বিশ্বাস আর মনের চিঠির মতো।
আজও আমি মাঝেমধ্যে লিখে ফেলি - রূপার নামে একেকটা চিঠি •|• হয়তো পাঠানো হয় না, কিন্তু মন জানে - সে পড়ে |
📌 •|• যে ভালোবাসা লেখা থাকে শেষ পাতার চিঠিতে, সেটাই হয়তো সত্য - সুন্দর ও প্রিয় •|•
বেঁচে থাকুক, প্রতিটা ভালোবাসা যুগের পর যুগ ধরে গল্প হয়ে আমাদের মাঝে |
সমাপ্ত